সাইক্লোন:প্রতি বছর কেন ? মুক্তির উপায় কি ?
বর্তমানের এক অতি পরিচিত বিভীষিকা ঘূর্ণবাত বা সাইক্লোন। প্রতিটা বছর এর ধ্বংস লীলা আমরা প্রত্যক্ষ করে চলেছি আমাদের যাপনে। এবছর ও মাত্র কয়েক দিন আগেই আছড়ে পড়ল 'ইয়াস' । সবে মে মাস, হয়তো আরও দু'-এক জন আছে অপেক্ষায়।
স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠে, কী এই ঘূর্ণবাত ? কেন ই বা এর ভয়াবহতা বার বার তছনছ করে দিচ্ছে উপকূলের জীবন ও জীবিকা ?
এ প্রশ্নের বিশ্লেষণ করতে হলে, একটু চোখ রাখতে হবে আবহবিদ্যার পাতায়। ক্রান্তীয় ও নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে গভীর নিম্নচাপ সৃষ্টির ফলে বায়ুপুঞ্জ, উত্তর গোলার্ধে ঘড়ির কাঁটার দিকে এবং দক্ষিণ গোলার্ধে তার বিপরীতে, প্রবল বেগে ঘুরতে ঘুরতে ঐ নিম্নচাপ কেন্দ্রের অভিমুখে অগ্রসর হয়। এটিই ঘূর্ণবাত বা সাইক্লোন নামে পরিচিত।
সাইক্লোন শব্দটির আক্ষরিক অর্থ 'সাপের কুণ্ডলী' । ১৮৩৬ - ১৮৫৫ এই সময়কালে হেনরী পিডিংটন তাঁর কোলকাতার ঝড় সংক্রান্ত গবেষণা পত্রে প্রথম এই শব্দটির উল্লেখ করেন।
অবস্থানগত দিক থেকে আমাদের ভারত ক্রান্তীয় জলবায়ুর অন্তর্ভুক্ত। এই ক্রান্তীয় অঞ্চলে ঘূর্ণিঝড় গড়ে ওঠার পেছনে বেশ কিছু আবহাওয়াগত শর্ত কাজ করে। সেগুলি হল --
১. পর্যাপ্ত তাপ ও জলীয় বাষ্পের উৎস
২. নিম্নচাপের উপস্থিতি
৩. তীব্র ঘূর্ণন বল বা coriolis force
৪. ঊর্ধ বায়ুমণ্ডলের অস্থিতিশীলতা
এই শর্তগুলো পূরণ হলে সমুদ্র পৃষ্ঠে ঘূর্ণিঝড় তৈরীর এক অনুকূল অবস্থা গড়ে ওঠে। এবার প্রশ্ন জাগতে পারে, ক্রান্তীয় ঘূর্ণবাত সমুদ্র ভাগেই সৃষ্টি হয় কেন ?
ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টির প্রাথমিক শর্ত ই হ'ল পর্যাপ্ত পরিমাণে আর্দ্রতা। বায়ুর এই আর্দ্রতা ঘূর্ণবাতের সংগঠনে প্রয়োজনীয় লীনতাপের যোগান দেয়। ফলস্বরূপ, ক্রান্তীয় ঘূর্ণবাত সৃষ্টিতে বিশাল জলরাশির উপস্থিতি ও পর্যাপ্ত বাষ্পীভবন প্রয়োজন। জলীয় বাষ্পের ঘনীভবন ও অধঃক্ষেপনের সময় মুক্ত লীনতাপ ঝড়ের শক্তির যোগান দেয়। তাই, ক্রান্তীয় ঘূর্ণবাত সৃষ্টির জন্য উষ্ণ সমুদ্রের উপস্থিতি আবশ্যক, যার ন্যূনতম তাপমাত্রা থাকে ২৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
অর্থাৎ, উষ্ণ সমুদ্র-পৃষ্ঠ সাইক্লোনের অন্যতম হোতা। গতবছর আমফান, বা, এবারের তখতে ও ইয়াস, প্রতি ক্ষেত্রেই সমুদ্র জলের উষ্ণতা ছিল ৩১-৩৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এই উষ্ণতা ই নিম্নচাপকে ঘূর্ণাবর্তের রূপ নিতে সাহায্য করেছে।
পরিসংখ্যান বলছে, বিগত কয়েক বছরে ভারত মহাসাগরে সৃষ্ট সাইক্লোনের সংখ্যা এবং শক্তি উভয় বেড়ে গেছে। এ প্রসঙ্গে কলোরাডোর National Center for Atmospheric Research (NCAR) এর গবেষক অধ্যাপক কেভিন ট্রেঞ্চবার্থ বলেছেন, "The 2018-19 South-West Indian Ocean cyclone season was the costliest and most active season ever recorded since reliable records began in 1967."
সাম্প্রতিক ঘূর্ণিঝড় গুলিকে খেয়াল করলে আরেকটি বিষয় ও চোখে পড়ে, আগে বেশিরভাগ ঘূর্ণিঝড় হয়েছে জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত, অর্থাৎ বর্ষার পরে। কিন্তু বর্তমানে প্রাক-মৌসুমী ঘূর্ণিবাতের ঘটনা বেড়ে গেছে।
শুধু ভারতীয় উপমহাদেশেই নয়, সারা পৃথিবী জুড়ে বর্তমানে শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড়ের উপদ্রব বেড়ে চলেছে, এবং বিজ্ঞানীরা অনেকাংশেই বিশ্ব উষ্ণায়নকে এই পরিস্থিতির জন্য কাঠগড়ায় দাঁড় করাচ্ছেন। বিগত কয়েক দশক ধরে গ্রীনহাউস গ্যাসের প্রভাবে বেড়েছে পৃথিবীর উষ্ণতা। বায়ুমণ্ডলের উষ্ণতার সাথে তাল মিলিয়ে বাড়ছে সমুদ্র জলের তাপমাত্রা। আর সমুদ্র পৃষ্ঠের এই বর্ধিত উষ্ণতায় সৃষ্টি করছে শক্তিশালী ঘূর্ণাবর্ত। সাথে সাথেই শক্তি যোগাচ্ছে এর দুই দোসরকে - বৃষ্টিপাত ও সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস।
বায়ুমণ্ডলের উষ্ণতা বেড়ে যাওয়ায় বেড়েছে বাতাসের জলধারণ ক্ষমতা। আর এই অতিরিক্ত জলীয় বাষ্প অনেক ক্ষেত্রেই ঘূর্ণিঝড়ের সময় ঘনীভূত হয়ে ঘটাচ্ছে প্রবল বর্ষণ।
সাম্প্রতিক ঘূর্ণবাতের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো, নিম্নচাপ থেকে শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড়ে রূপান্তরের বিষয়টি ঘটছে খুব দ্রুত। ফলে, ঝড়ের গতিবেগ সম্পর্কে সঠিক পূর্বাভাস দিতে বেগ পেতে হচ্ছে বিজ্ঞানীদের।
এই জলবায়ু পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে ঘূর্ণিঝড়-তাড়িত সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস ও ঝড়ের তীব্রতা, এই মূল সমস্যাদুটিকে কিছুটা হলেও আটকিয়ে উপকূল অঞ্চলকে একটু স্বস্তি দিতে পারতো যে বাদাবন, দুঃখের বিষয়, আমারা সেটিকেও অবলীলায় ধ্বংস করে চলেছি। সুন্দরী, গরান, গেঁওয়া, কাঁকড়া, কেয়া - বাদাবনের এইসব অধিবাসীরা তাদের বিশেষ শিকড়ের সাহায্যে সমুদ্র স্রোতের ক্ষয় রোধ করে, এবং প্রাচীরের মতো আগলে ঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের তীব্রতাকে কমিয়ে দেয়। আজ সুন্দরবন তার এই রক্ষাকর্তা কে অনেকটাই হারিয়ে ফেলেছে। ফলে ঝড়ের প্রভাব হচ্ছে আরও মারাত্নক। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য ইয়াসের প্রভাবে দীঘা ও মন্দার মনির দুরাবস্থা। প্রাকৃতিক বালিয়াড়ি ও ঝাউবন এক নিমিষে শেষ করে দিয়ে হোটেল ব্যবসা গড়ে না তুললে, এ এলাকার পরিস্থিতি এতটা খারাপ হ'ত না।
ঘূর্ণিঝড় আবার আসবে, ফিরবে তার বিধ্বংসী রূপ নিয়ে। আমাদের অর্থনৈতিক কার্যকলাপ যে বিশ্ব উষ্ণায়ন ঘটিয়েছে, তার সাথে ঘূর্ণবাতের গাঁটছড়া বাঁধা হয়ে গেছে। পাশাপাশি, বেড়ে চলেছে সমুদ্র জলতলের উচ্চতা। এখান থেকে ফেরার উপায়ের হদিশ এখন একমাত্র কল্পবিজ্ঞানে। কিন্তু ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা কমাবার সময় এখনও আছে।
অর্থলিপ্সা ছেড়ে একটু সচেতন হতে হবে আমাদের। ঝড়ের পরে উপকূল অঞ্চলে শুধু কংক্রিটের বাঁধ দিলেই হবে না, সরকারকে মাথায় রাখতে হবে স্থিতিশীল উন্নয়নের কথা। Coastal Regulation Zone (CRZ) - কে সুরক্ষিত রাখতে হবে, সেখানে জমি মাফিয়াদের তোল্লায় দেবার অর্থ নিজেদের সর্বনাশ ডেকে আনা। আর অতি অবশ্যই রক্ষা করতে হবে ম্যানগ্রোভ অরণ্য। যদি এগুলো করতে পারি, তবেই ভবিষ্যৎ বিপর্যয়ের মোকাবিলা সম্ভব। তা না হলে, সেদিন আর দেরী নেই, যখন পৃথিবীর মানচিত্র থেকে শুধু সুন্দরবন নয়, মুছে যেতে পারে কোলকাতাও।
অসাধারণ। ...জনসচেতনতার একটা সুন্দর
ReplyDeleteপদক্ষেপ .......
বেশ ভালো হয়েছে
ReplyDelete