আমরা প্রতিদিনের ক্লান্তি নিয়ে ঘরে ফিরি। প্রেমিকার স্পর্শে হই মুহ্যমান-কবি শঙ্খ ঘোষের আলোচনায় : ধীমান ব্রহ্মচারী
আমরা প্রতিদিনের ক্লান্তি নিয়ে ঘরে ফিরি।প্রেমিকার স্পর্শে হই মুহ্যমান-কবি শঙ্খ ঘোষের আলোচনায়: ধীমান ব্রহ্মচারী
(ক)
'এই তো, রাত্রি এলো।
বলো,এখন তোমার কথা বল।'
আমরা যারা কবিতাকে আঁকড়ে নিয়ে সর্বদা বেঁচে থাকি,তারা হয়তো জানি কবিতা কী?কেন?কীভাবে?কখন?-এরকম অনেক প্রশ্নচিহ্ন দিয়ে তৈরি করা যায় কবিতার দেহ।কবিতার শরীর।আর এই কবিতার আলোচনায় যখন আসেন আমাদের কাছের বাংলা ভাষার এক সহজিয়া কবি।নাম শঙ্খ ঘোষ।একটা পুরো জীবন কেটে যাবে শঙ্খ ঘোষকে নিয়ে আলোচনা করতে গেলে।আবার তারচেয়েও বড় কথা এক জীবনের আমার মতো ছোট্ট জীবন দেখা মানুষের বিরাট জীবন দেখাও হয়ে উঠবে না,এই স্বল্প পরিসরের চলার পথে।আসলে মানুষ তার চেতনার মধ্যে সর্বদা খুঁজে বেরান তার অস্তিত্ব।সেই অস্তিত্বের স্বরূপ একজন কবি খুঁজে পান তাঁর চেতনায়,কাব্য সাধনার মধ্য দিয়ে।আমাদের শঙ্খ ঘোষও এর ব্যতিক্রম নন।
কবিতা ও কবি' এই শব্দ দুটিই আমাদের সমাজ জীবনের পথে প্রভাব ফেলে।এবং এই প্রভাব যে কি পরিমানে তার ইয়ত্তা নেই।পূর্ণেন্দু পত্রী তাঁর একটি বই(প্রসঙ্গ : শিল্প, সাহিত্য)এ একটি আলোচনায় লিখছেন,'এ কবিতা নিয়ে গভীর তাত্ত্বিক আলোচনার তর্ক-ঝড় বয়ে গেছে এক সময়,শঙ্খ ঘোষ বনাম আবু সয়ীদ আইয়ুব-এর মধ্যে।শঙ্খ ঘোষের আশ্চর্য অনুভব-সম্পাতে সে কবিতার ভিতর থেকে একে একে খুলে যেতে থাকে গুটানো দল।আর তিনি আমাদের মনে করিয়ে দেন-এ-কবিতার সূর্য তাঁর ইছাপূরণের দৈব-আলো,স্নাত হলেই চরিতার্থ হবেন যাতে।
শঙ্খ ঘোষ জানান---
"...রবীন্দ্রনাথের কবিতায় সূর্য শব্দ অথবা সূর্যের ছবি কতো অসংখ্যবার ব্যবহৃত সেই বাল্য বয়স থেকে,অথচ তা সত্ত্বেও একটু বিস্ময় বোধ হয় এই দেখে যে সূর্য এখানে তেমন কোনো প্রথাবহনের ক্লিষ্টতা নিয়ে দাঁড়ায় না,প্রায় নতুন তাজা শব্দের ক্ষমতা নির্ভর করে শব্দবন্ধনের উপর।..."
আসলে কবিতার অনুভূতি যে শুধুমাত্র সেই কবিতার শব্দ প্রয়োগের নিরিখেই মেনে নেওয়া তা কিন্তু নয়।শব্দের সঙ্গে নিজের হাত,তারসঙ্গে নিজের প্রেমময়ী মন এবং তারও সঙ্গে একেওপরের একাত্ম হয়ে চলা, এও এক সাধনা।সেই সাধনা কবিরা যুগ যুগ ধরে করে এসেছেন।তা সে রবীন্দ্রনাথ থেকে জীবনানন্দ হয়ে শক্তি-সুনীল ও শঙ্খ পর্যন্ত বিস্তৃত।
এভাবে যখন কোন কোন সময় কোন কবির কবিতা পড়ি, তখন আমি কেন,আমার মনে হয় জগতের সব কবিদের অনুভূতি এক লহমায় একই তড়িৎ অনুভব হয়।আমরা গভীর অন্ধকারের একটা নির্জন রাস্তায় এসে দাঁড়াই।কেউ সেখানে থাকে না।থাকে আমি আর আমার অনর্গল পড়ে যাওয়া কবিতা।এই প্রসঙ্গে একটা লেখার কথা মনে আসছে।আমার খুব প্রিয় এক কবি জয় গোস্বামীর লেখা একটা বই।নাম জয়ের সুনীল।দেজ পাবলিশিং থেকে বইটি প্রকাশ হয় ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে।সেখানে একটা আলোচনায়,জয় লেখেন সুনীলেরই একটি কবিতার প্রসঙ্গ :
'আমিই সেই মানুষ,আমাকে চেয়ে দেখো
আমি ফিরে এসেছি
আমার কপালে রক্ত;
বাষ্প-জমা গলায়,বাস-ওল্টানো ভাঙা রাস্তা দিয়ে ফিরে এলাম--
আমি মাছহীন ভাতের থালার সামনে বসেছি
আমি দাঁড়িয়েছি চালের দোকানের লাইনে
আমার চুলে ভেজাল তেলের গন্ধ
আমার নিশ্বাস--'
কি ভয়ানক একটা বাস্তব চিত্র।প্রত্যেকটা ঘটনার ছবি আমাদের নাদেখা নয়।আমরা প্রতিদিন প্রতিনিয়ত এভাবেই বেঁচে থাকি,আমাদের জীবনে।ঠোক্কর খেতে খেতে যন্ত্রনা উগলে দিই নিভৃতে।আর এই নিভৃত স্থান কোন গোপন সঙ্গিনীর কোল।কবিতার পা স্পর্শ করে আমরা বার বার সেই বেআব্রু কোলের ফাঁকে মুখ গুজে থাকি,যন্ত্রণা লোকানোর চেষ্টা করি।খুঁজি, খুঁজে খুঁজে চলি আজীবন কোন অন্ধকার।সেই অন্ধকারও তো কোন মৃত্যুর উপত্যকা।সেই উপত্যকাও হয়তো কোনভাবে ধরে দেয়,শঙ্খ বাবুর কথায় : 'এই খোলা দুপুরে তোমার মুখে ধরেছি বিষের ভাঁড় তুমি খেয়ে নাও'।আমরা হয়তো এভাবেই কবিতার সঙ্গে কোথাও এক সরল রেখায় ঢুকে যায়,আমাদের চেতনার প্রবাহে।
(খ)
আসলে কবি তাঁর নিজের চলার পথ অর্থাৎ জার্নি টা খুব ভালোভাবে বুঝতে পারেন।শব্দের প্রয়োগ ও তার সঙ্গে ঘটমান অর্থাৎ ঠিক সেই সময়ের মধ্যে দিয়ে বয়ে যাওয়া সমাজ,জীবন,সংস্কৃতি এমনকি সামগ্রিক সভ্যতা।এসব কিছুইতো কবি নিজে নিজে দেখেন।অনুভব করেন।করেন উপলব্ধি।তাই তো শঙ্খ বাবু অনায়াসে লিখতে পারেন আমাদের মনের কথা :
'দুনিয়ার যদি কিছু লাভ হতো আমি না থাকলে
আমার না-থাকা সহজেই হতো--
কিন্তু সেটা কি হবে বলে তুমি ভাবো?'
আসলে কবিতার মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে একটা সময় চলার পথ শেষ হয়।তখন অন্য পথ বা অন্য বাঁক নিতে হয় আমাদের।কবিতার এই বিরাট আঙিনায় জীবনানন্দ থেকে শঙ্খ ঘোষ প্রত্যেকেই এই বাঁক থেকে পথ পরিবর্তন করেছেন।কালের নিয়মেই সেই পরিবর্তন কে স্বাগত জানিয়েছেন এঁরা।তাই একটা সময়ের পর নিজের ক্ষণকাল সম্পর্কে একটা প্রশ্নের উত্থাপন সজাগ ভাবেই করেছেন।খুব সূক্ষ্ম ভাবেই ভেবেছেন।তাইতো তিনি লিখেছেন-'আমার না-থাকা সহজেই হতো'।খুব ভালোভাবে কবি বুঝেছেন তাঁর থাকা না থাকার প্রাসঙ্গিকতা।জীবনের ক্ষিয়মানতা নিয়ে সংশয় হয়ে থাকা কবি,কতটা নিভৃতে ভেবে তবেই প্রকাশ্যে অনুমান করতে পারেন,তাঁর বেঁচে থাকার সন্দেহ।
যদি খুব ভালোভাবে খেয়াল করি,তাহলে দেখব নিজের থাকার অর্থাৎ বেঁচে থাকার কালেই তিনি যেন মৃত্যুর বাতাবরণ তৈরি করছেন।আবার এই পরিবেশ তৈরির কারণ যে খুব একটা অপ্রস্তুত ব্যাপার স্যাপার,তা কিন্তু নয়।আসল কারণ বিরাট সভ্যতার সময়ক্ষন ধরে একটি মানুষের জীবন প্রবাহের দ্যুতি যে কখন স্থির হয়ে যাবে,তা অনেকেরই অজানা থাকে।কারণ কালের নিয়ম বা নিয়তির নিয়ম জানা যে আমাদের কারোরই সম্ভব নয়।তাই তো শঙ্খ ঘোষের অনেক আগেই আমাদের সাতটি তারার তিমির' কাব্যের কবি বলে যান :
'সিন্ধুশব্দ, বায়ুশব্দ, রৌদ্রশব্দ, রক্তশব্দ,মৃত্যশব্দ এসে/ভয়াবহ ডাইনীর মতো নাচে-ভয় পাই,গুহায় লুকাই'।
আমরা প্রতিদিনের ক্লান্তি নিয়ে ঘরে ফিরি।প্রেমিকার স্পর্শে হই মুহ্যমান।ক্লান্তি সরে দূরে।চোখে নেমে আসে ঘুম।ঘুমোতে ঘুমোতে আমরা যখন অবচেতনের কেন্দ্রে ঢুকে পড়ি।তারপর সেই,আবারও অন্ধকার।অন্ধকার সেই নিভৃত গুহার চারপাশ।সেই অন্ধকার যেন যোনির মতো।যোনির অঙ্গে মিশে যেতে যেতে আমরা বুদ হয়ে যায় ঘোড়ে।সেই ঘোড় কেটে আবার সকালের সূর্যের আলোয় ভাঙে ঘুম।কেটে যায় ধোঁয়াশার নেশা।কখন ঘুমের ঘোড়ে এলার্ম বেজে ওঠে।
Comments
Post a Comment