সম্পাদকীয় বিভাগ
রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল
ছবি ইন্টারনেটের সৌজন্যে |
সুদর্শন চ্যাটার্জী : ঊনবিংশ শতকের সায়াহ্নে পরাধীন দেশের আকাশে আবির্ভাব হয় এক উজ্জ্বল জ্যোতিস্কের যাঁর পরিপূর্ণ ছটায় ঘুচে যায় সংকীর্ণ স্বার্থের জীর্ণতা মহামিলনের এক দৈবীয় পরিস্ফুটনে । তিনি নজরুল - কাজী নজরুল ইসলাম । আজকেরই দিনে ১৮৯৯ সালে বর্ধমানের এক অখ্যাত গ্রাম চুরুলিয়ায় জন্ম হয় তাঁর । দারিদ্র , তাঁকে প্রথাগত শিক্ষার সুযোগ দেয়নি ঠিকই কিন্তু তিনি ছিলেন মানবিক শিক্ষার জ্বলন্ত মশাল , যে মশালের তীব্র ঔজ্জ্বল্যে চুরমার হয়ে গিয়েছিল তত্কালীন সমাজের কুসংস্কারচ্ছন্ন অন্ধকার , যাঁর বিদ্রোহী হুংকার টলিয়ে দিয়েছিল তত্কালীন ব্রিটিশ সিংহাসন । বাংলা সাহিত্য , সঙ্গীত , সংস্কৃতি এবং কৃষ্টির অঙ্গনে তাঁর অসীম সৌরভ বিকশিত করেছে বাঙ্গালীর গৌরব এক অনন্ত পরিপূর্ণতায় । তাঁর সঙ্গীত , কাব্য , সাহিত্য ; তাঁর লেখনীতে সদা ফুটে উঠেছে মানুষের কথা , মানবিকতার কথা । তিনি একাধারে বিদ্রোহী , একাধারে বিদ্রোহ, একাধারে প্রেমিক , একাধারে প্রেম , একাধারে কবি , একাধারে কবিতা , একাধারে সঙ্গীতজ্ঞ , একাধারে সঙ্গীত - এ যেন অসীমের সমাবেশ একই আধারে! নজরুল যখন বাংলা কৃষ্টির কাননে পদার্পণ করেন , ইতিমধ্যেই রবীন্দ্রনাথ আর বাংলা যেন মিলে মিশে এক হয়ে গেছে । এরই মধ্যে তাঁর আবির্ভাব যেন নূতনের দূত হয়ে । নিজ মহিমায় , নিজ গরিমায় তিনি বাংলার সংস্কৃতি জগতকে দিলেন এক অন্য পরিচয় যে পরিচয় কখনোই পূরাতনকে অস্বীকার করে বা রবীন্দ্রনাথের গৌরবকে অবমাননা করে নয় বরং এক নব আন্দোলনের অনন্য পথিকৃৎ হয়ে যা পরবর্তীকালে বাংলা তথা বাঙালি জাতিকে এক নবীন দীপ্তিতে আলোকিত করে যা চিরনবীন , চিরকালীন । রবীন্দ্রনাথ যদি বাঙালি সত্তার এক দিক হন তবে বিপরীত দিকে নজরুলের অধিকারই সর্বাগ্রে । কিন্তু তাঁর প্রাপ্য , যথোচিত মর্যাদা বা সন্মানটুকু আমরা , বিশেষত এপার বাংলার মানুষ কি দিতে পেরেছি ? আজ তাঁর জন্মদিবসে দাঁড়িয়ে প্রশ্নটা কিন্তু ভাবায় । ২৫শে বৈশাখ দিনটি কী কারণে স্মরণীয় তা প্রায় প্রতিটি বাঙালি শিশুই জানে কিন্তু আজকের দিনটির তাত্পর্য হয়তো আমার , আপনার মতো অনেক শিক্ষিত , মননশীল বাঙালির কাছে ততটাও গুরুত্বপূর্ণ নয় যার ফলে আমরা মনেই রাখিনা এই তারিখটি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ; যা সত্যিই বাঙালি জাতি হিসেবে আমাদের দুঃখ এবং হীনমন্যতার পরিচয় বহন করে । কথাটা খুব ভালো না লাগলেও , বাস্তব কিন্তু মিথ্যে বলে না । তবে এ কথা ঠিক যে বিগত বেশ কিছু বছরে নজরুল চর্চা নিঃসন্দেহে বেড়েছে তবে সেটা কি যথেষ্ট ? প্রশ্নটা রয়েই যায় । ইদানীং কালে নবীন শিল্পীরা তাঁদের সঙ্গীত জীবনের শুরুতে অধিকাংশ সময়ই গানের বিষয়বস্তু হিসেবে রবীন্দ্রনাথকে বেছে নেন যা কোনোমতেই হেয় করার কারণ নয় কিন্তু গুটি কয়েক শিল্পী বাদে ক'জন শিল্পী নজরুলকেও সেই সন্মানটুকু দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেন ? অবশ্যই এ ধারায় পরিবর্তন আসছে এবং সেটিই কাম্য কিন্তু বর্তমান যুব বাঙালির মননে কবিগুরুর পাশপাশি এই বিদ্রোহী কবিরও যাতে সার্থক অবস্থান দৃঢ় হয় , তার দায়িত্বও কিন্তু আমাদেরই । বর্তমানে সোস্যাল মিডিয়ার যুগে , প্রতিটি জায়গায় রবীন্দ্র জয়ন্তীতে , রবীন্দ্রনাথকে, প্রতিটা বাঙালির যে শ্রদ্ধা নিবেদনের অদম্য স্পৃহা পরিলক্ষিত হয় , কই আজকের দিনে তো সেই উন্মাদনা দেখা যায়না ? বক্তব্য , রবীন্দ্র-নজরুল দ্বন্দ বা তুলনা নয় - এঁরা দুজনেই বাংলার সমার্থক ; ভাববার বিষয় এইটাই যে নজরুল আমাদের যা কিছু উজাড় করে দিয়েছেন , তাঁর পরিবর্তে আমরা তাঁকে কতটুকু দিতে পেরেছি ? তাঁর ঋণ আমাদের প্রতি , নিঃসন্দেহে অপূরণীয় কিন্তু তাঁকে আমাদের মধ্যে বাঁচিয়ে রাখার কর্তব্য কিন্তু আমাদেরই ! আজ তাঁর জন্মদিবসে দাঁড়িয়ে এই প্রতিজ্ঞাই যেন আমরা নিই যে নজরুল চর্চা বাড়ুক , নজরুল ছড়িয়ে যান প্রতিটা বাঙালি মননে , অন্তরে আরো আরো বেশি ।
Comments
Post a Comment